বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তেজনা, ভারতে ব্যবসায় ধস!
- আর্ন্তজাতিক ডেস্ক
- প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০১:০৮ PM , আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০১:০৮ PM

মোহাম্মদ আহমদ আনসারি সারাজীবন কাটিয়েছেন ভারতের আধ্যাত্মিক রাজধানী বলে পরিচিত শহর বারাণসীর সঙ্কীর্ণ ও ভিড়ভাট্টার গলিতে—যেটি আবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী এলাকা।
৫৫ বছর বয়সী আনসারি দশকের পর দশক ধরে বুনে আসছেন বেনারসি শাড়ি। মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি আর আজানের সুরের পটভূমিতে তাঁতযন্ত্রের খটখট শব্দ তিনি ভীষণ উপভোগ করেন। প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ সাল থেকেই বসতি হিসেবে পরিচিত এবং হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির মিলনের জন্য প্রসিদ্ধ এই প্রাচীনতম শহরের অন্যতম কারিগর তিনি।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিক্রি কমে গেছে নানা কারণে—সর্বশেষ ধাক্কা এসেছে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের টানাপোড়েন থেকে।
গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে পালিয়ে গেলে দুই মিত্র দেশের সম্পর্ক তীব্র সংকটের মুখে পড়ে।
বাংলাদেশ তার সমস্যার জন্য আংশিকভাবে ভারতকে দায়ী করছে—বিশেষত হাসিনার শাসনামলে মোদীর প্রকাশ্য সমর্থনের কারণে।
হাসিনার পতনের পর সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় এবং ভারতীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে, কারণ তাদেরকে হাসিনার ঘনিষ্ঠ বলে দেখা হয়। ঢাকা এখন হাসিনাকে দেশে ফেরত চেয়ে বিচারের মুখোমুখি করতে চাইছে। তবে ভারত এ বিষয়ে মুখ খুলছে না।
এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ ভারত থেকে সুতা ও চালসহ কিছু পণ্যের আমদানি সীমিত করে। এর জবাবে ১৭ মে ভারত সীমান্তপথে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে। যদিও বাংলাদেশ এখনও শাড়ি ভারতে পাঠাতে পারে, কিন্তু তা শুধুমাত্র ব্যয়সাপেক্ষ ও সময়সাপেক্ষ সমুদ্রপথে সম্ভব।
বিশ্বখ্যাত বেনারসি শাড়ি বিলাসবহুল রেশম, সূক্ষ্ম কারুকাজ এবং স্বর্ণ-রৌপ্যের তারের জমকালো জরির কাজের জন্য পরিচিত। একটি শাড়ি তৈরি করতে কখনও কখনও ছয় মাস পর্যন্ত সময় লাগে। এসব শাড়ির দাম এক লাখ রুপি (১,১৩০ ডলার) বা তার বেশি পর্যন্ত হয়।
বাংলাদেশে উৎসব ও বিয়ের মৌসুমে এসব শাড়ির প্রচুর চাহিদা থাকে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যবসা ৫০ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে বলে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন আনসারি।
এটি বেনারসি শিল্পের জন্য সর্বশেষ ধাক্কা। এর আগেও সরকারী নীতিমালা—যেমন নোট বাতিল, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি—এবং কোভিড-১৯ মহামারী ও সস্তা পাওয়ারলুম প্রতিযোগিতা তাদের চাপে ফেলেছিল।
ফলে অনেক তাঁতী পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। একসময়ের চার লাখ তাঁতীর সংখ্যা কমে এখন প্রায় দুই লাখে নেমে এসেছে। বাকিরা অন্যত্র কাজের সন্ধানে গেছেন বা রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
পাওন যাদব (৬১) বারাণসীর এক পাইকারি শাড়ি ব্যবসায়ী, বলেন, বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনের পর থেকে ব্যবসা একেবারেই থমকে গেছে।
“আমরা প্রতিবছর প্রায় ১০,০০০ শাড়ি বাংলাদেশে সরবরাহ করতাম। এখন সব থেমে গেছে। আমি এখনও বাংলাদেশের ক্রেতাদের কাছে প্রায় ১৫ লাখ রুপি (১৭,১৪০ ডলার) পাবো, কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেই টাকা আদায় প্রায় অসম্ভব,” বলেন তিনি।
ভারতে শাড়ি পরার ১০৮টি ভিন্ন ধারা আছে। নকশা ও রঙের সমৃদ্ধির কারণে এগুলো বিশ্বজুড়েই সমাদৃত।
দেশটির সরকারি তথ্য অনুযায়ী কৃষির পরেই সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান রয়েছে টেক্সটাইল খাতে। প্রয় সাড়ে ৩ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এই খাতের সাথে যুক্ত। শাড়ির বাজারের মূল্য আনুমানিক ৮০,০০০ কোটি রুপি (৯ বিলিয়ন ডলার), যার মধ্যে রপ্তানি প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার।
বারাণসীর তাঁতী ও ব্যবসায়ীরা যারা মোদিকে পরপর তিনবার ভোট দিয়েছেন, এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বাংলাদেশ ইস্যুতে সমাধান প্রত্যাশা করছেন।
২০১৫ সালে মোদি সরকার ৭ আগস্টকে জাতীয় হ্যান্ডলুম দিবস ঘোষণা করে এবং তাঁতশিল্পীদের জীবনমান উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা তেমন কাজে আসেনি বলে জানালেন ব্যবসায়ী ও তাঁতীরা।
“ভারতের হ্যান্ডলুম শিল্প অনন্য, এর সমকক্ষ অন্য কোনো দেশ নেই। কিন্তু পর্যাপ্ত ব্যবসা বা আয়ের নিশ্চয়তা না থাকায় অনেকে পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। এখন তরুণ তাঁতী খুঁজে পাওয়া কঠিন,” বলেন সেভ দ্য লুম সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা রমেশ মেনন।
“বর্তমান সময়ে প্রয়োজন হ্যান্ডলুমকে বিলাসবহুল পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা, দারিদ্র্যের প্রতীক হিসেবে নয়, যোগ করেন তিনি।”
পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীদের স্বস্তি
তবে পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গে একেবারেই ভিন্ন। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এই রাজ্যে শাড়ি বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
বাংলাদেশি শাড়ির কারণে এতদিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গের তুলোর শাড়ি ব্যবসা। কিন্তু এ বছর দুর্গাপূজা উপলক্ষে তাদের বিক্রি বেড়েছে।
শান্তিপুরের ব্যবসায়ী তারকনাথ দাস (৬৫) বলেন, “বাংলাদেশি শাড়ি আমাদের বাজারের অন্তত ৩০ শতাংশ দখল করেছিল। এখন আমরা ধীরে ধীরে পুরোনো বাজার পুনরুদ্ধার করছি। এবারের উৎসবে বিক্রি গত বছরের তুলনায় অন্তত ২৫ শতাংশ বেড়েছে।”
শান্তিপুর ও আশেপাশের এলাকায় এক লক্ষাধিক তাঁতী ও ব্যবসায়ী আছেন। নাদিয়া জেলার এই অঞ্চল সূক্ষ্ম তুলোর শাড়ির জন্য বিখ্যাত। হুগলি ও মুর্শিদাবাদ জেলার শাড়িও জনপ্রিয়, যা গ্রিস, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়।
নদিয়া জেলার আরেক ব্যবসায়ী সঞ্জয় কর্মকার (৪০) বলেন, “বাংলাদেশি শাড়ি আকর্ষণীয় প্যাকেজিং আর সামান্য ভালো মানের কাপড় ব্যবহার করায় আমাদের বাজার হারাচ্ছিল। এখন আমরা কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি।”
ফ্যাশন বিশেষজ্ঞ শান্তনু গুহ ঠাকুরতা (৬২) বলেন, “বাংলাদেশ থেকে আমদানি বন্ধ হওয়ায় ভারতীয় তাঁতী ও ব্যবসায়ীরা বিরাট সুবিধা পেয়েছে। সস্তা নকল পণ্যও বন্ধ হয়েছে। উৎসবের ঠিক আগে এই পদক্ষেপটি খুব কাজে দিয়েছে।”
সূত্র: আল জাজিরা