ঢাকেবি'র নেপথ্যে 'বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ষড়যন্ত্র'!

সাত কলেজ
  © সংগৃহীত

ঢাকার সরকারী সাত কলেজের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি বাতিল করে 'ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকেবি) স্থাপনের নেপথ্যে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর 'ষড়যন্ত্র' দেখছেন সংশ্লিষ্ট কলেজের শিক্ষকরা। তাদের অভিযোগ, মূলত ঐতিহ্যবাহী এ কলেজগুলোর প্রায় দেড় লক্ষাধিক শিক্ষার্থীদের ভাগিয়ে নিয়ে শত শত কোটি টাকার ভর্তি বাণিজ্য করতেই মোটা অংকের টাকা বিনিয়োগ করছে অধিকাংশ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। এজন্য তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় সুবিধাবাদী শিক্ষকদের দিয়ে কৌশলে নতুন এ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কাজটি করিয়ে নিচ্ছে। 

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থী কিছু শিক্ষক তাদের বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন পদে আসীন হতে চেয়েছিল। কিন্ত নানান বাস্তবতায় তারা তাদের কাঙ্খিত জায়গায় বসতে না পেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত সাত কলেজ দিয়ে খায়েশ মেটানোর ফন্দি আঁটে।

এরই ধারাবাহিকতায় তারা ৭ কলেজের শিক্ষার্থীদেরকে দিয়ে একটি স্বতন্ত্র নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের সূচনা করান। একের পর এক  নানান ইস্যুতে তাঁরা আন্দোলনে 'ঘি' ঢালেন। এরই প্রেক্ষিতে এক পর্যায়ে 'ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়' প্রকল্পের সূচনা হয়। আর তাদের এই প্রকল্পে কৌশলে মোটা অংকের অর্থায়ন করছে দেশের অধিকাংশ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। যার সাথে ইউজিসি'র একটি অসাধু চক্রও জড়িত রয়েছে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, চর্তুমূখী ষড়যন্ত্রের মধ্যেও ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকার যখন দেশে একটি স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কাজ করছে তখন সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সরকার বিরোধী একটি চক্র মরিয়া হয়ে উঠেছে। সেই নীল নকশার অংশ হিসেবেই ঢাকার সাত কলেজ নিয়ে নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অযৌক্তিক দাবিকে সামনে এনে মাঠে নেমেছে চক্রটি। তাদের এ উদ্দেশ্য হাসিলে তারা সাত কলেজের কিছু শিক্ষার্থীদেরকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়ে ব্যবহার করছে। 

এদিকে মফস্বলের নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত সংসার থেকে আসা অধিকাংশ শিক্ষার্থীদেরই টার্গেট থাকে ঢাকার একটি ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া। কিন্তু নানান কারণে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ না পাওয়া এসব  শিক্ষার্থীদের শেষ ভরসা তখন ঢাকার সরকারী কলেজগুলো, যার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সরকারী সাত কলেজ অন্যতম।

কিন্তু কোনো রকম বাস্তব পর্যালোচনা ছাড়াই এই সাত কলেজকে যদি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়, তাহলে সেখানে আর আগের মতো ভর্তির বিশাল সুযোগ থাকবে না। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো সাধারণত সিলেকটিভ হয়, আসনসংখ্যাও সীমিত থাকে। এর ফলে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা শিক্ষার্থীদের বিরাট একটি অংশের জন্য উচ্চশিক্ষা দুর্লভ হয়ে যাবে। তখন বিকল্প হিসেবে থাকবে ব্যয়বহুল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বা বেসরকারি কলেজ, যা বেশিরভাগ পরিবারের সাধ্যের বাইরে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে তাদের বাণিজ্যটাকে জমজমাট করতে মরিয়া। তাই তারা কৌশলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় সুবিধাবাদী শিক্ষক ও ইউজিসির একটি অসাধু চক্রকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল ও শিক্ষার্থী ভর্তির পরিধি ছোট করার মিশনে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে বলে মনে করছেন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারা এটিকে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর 'ষড়যন্ত্র' বলেই মনে করছেন।

এজন্য মঙ্গলবার ঢাকার সাত কলেজের শিক্ষকরা 'ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠার অযৌক্তিকতা তুলে ধরে আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় তারা প্রথমদিন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ডিজির নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষোভ জানিয়েছেন। একই দাবিতে সাত কলেজেরসহ বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা আজ বুধবার ইউজিসির চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করে তাদের দাবি পেশ করবেন বলে জানা গেছে।   

সাত কলেজ সূত্র জানা গেছে, এসব কলেজ বর্তমানে প্রায় দেড় লক্ষাধিক সাধারণ শিক্ষার্থীর জন্য স্বল্প খরচে উচ্চ মাধ্যমিক থেকে অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা রয়েছে।  এসব কলেজগুলোতে ছেলে- মেয়েদের জন্য আলাদা এবং সহশিক্ষা কার্যক্রমের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবিত ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন হলে এই ব্যবস্থা থাকবে না বলে ইতিমধ্যেই সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। সরকার প্রস্তাবিত এ বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি হাইব্রিড বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে যার ধারণাও এখনো পরিস্কার হয়নি। 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ও সাত কলেজের অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসক অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস বাংলাকন্ঠকে বলেন, বিষয়টি শিক্ষা উপদেষ্টা ব্যাপার। তাই আমি বিস্তারিত কিছু বলতে চাই না। তবে আমাদের প্রস্তাব ছিল যাই করা হোক না কেন, কলেজগুলোর যেন স্বতন্ত্রতা বজায় থাকে। 

এদিকে সাত কলেজসহ বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলছেন সরকার যদি সাত কলেজকে বাদ দিয়ে একটি পৃথক স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করে সেক্ষেত্রে তো কোনো সমস্যা নাই। তারা বলছেন, আমরা যদি চট্টগ্রাম, রাজশাহী বা যেকোনো নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ইতিহাস দেখি তাহলে দেখা যাচ্ছে মূল শহর থেকে কিছুটা দূরে স্থাপন করা হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় জমি পাওয়া সহজ হয় এবং শহরের জ্যাম এড়ানো যায়। কিন্তু ঢাকার মতো একটা মেগা শহরের ৭ কোনায় ৭টি কলেজ নিয়ে নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলে শিক্ষার্থী এবং নগরবাসীর ভোগান্তি আরও বাড়বে। ঢাকার ৭ কলেজে বর্তমানে প্রায় দেড় লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর জন্য প্রায় ১৪০০ শিক্ষক কর্মরত আছেন। 

এসব শিক্ষকরা বলছেন, যদি সাত কলেজকে সরাসরি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়, তাহলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই অবস্থা হবে। যেখানে কলেজের সুযোগ হারিয়ে গেছে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামো এখনো পরিপূর্ণ নয়। কেননা, জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের ফলে সৃষ্ট আবাসন, অবকাঠামো, জনবলসহ নানাবিধ সংকটের সমাধান ২০ বছরেও সম্ভব হয়নি। সমাধানের পথ হিসেবে দফায় দফায় আন্দোলনকেই বেছে নিতে হয়েছে এবং সেখানে শুধু শিক্ষার্থীরাই নন, শিক্ষকেরাও আন্দোলনে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছেন। কেরানিগঞ্জে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি বরাদ্দ করা হয়েছে। যদি শুরুতেই কেরানিগঞ্জে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি বরাদ্দ দেওয়া হতো তাহলে জগন্নাথ কলেজটাও থাকতো সাথে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ও তৈরি হতো।

তাঁরা বলছেন, ঢাকায় বা পার্শ্ববর্তী এলাকায় নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করলে সাত কলেজের সাধ্যের মধ্যে থাকা উচ্চশিক্ষার সুযোগ রক্ষা পাবে, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণ ও গবেষণা বাড়বে। সেই সঙ্গে সাত কলেজের উচ্চমাধ্যমিক, অনার্স মাস্টার্স পর্যায়ের ছাত্র এবং কলেজ হিসেবে তাদের ঐতিহ্যকেও আমলে নিতে হবে। কিন্তু  সাত কলেজ যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়, তাহলে কাদের জন্য হবে এই পরিবর্তন? সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য, না উচ্চশিক্ষার অলিন্দে অভিজাত শ্রেণির জন্য? এমন প্রশ্নও করছেন শিক্ষকরা। 

এদিকে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখায় বলা হয়েছে, ইডেন কলেজে ছেলেরা ক্লাস করতে যেতে পারবে, আবার ইডেনের মেয়েরা ঢাকার অন্য ৬ টি কলেজে একইভাবে ঘুরে ঘুরে ক্লাস করতে যেতে পারবে। এমন চিন্তাকে উদ্ভট বলেই মন্তব্য করছেন শিক্ষকরা। তাদের অভিযোগ, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ও অংশীজনদের কাছে এসব তথ্য গোপন করে রাজনৈতিক সরকার আসার আগেই গোপনে অধ্যাদেশ জারির চেষ্টা চলছে। এটা হতে পারে না। 

শিক্ষকরা আরো বলছেন, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ জারি হলে হাজার হাজার শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগের মহোৎসব চলবে। এদের আবাসন কোথায়? শিক্ষার্থীদের আবাসন কোথায়? সরকারের এমন সিদ্ধান্ত শিক্ষাঙ্গনকে আরো অস্থির করার নতুন পায়তারা বলেই মনে করছেন তাঁরা।

অপরদিকে সরকারের সিদ্ধান্ত ও পরামর্শ ছাড়াই সাত কলেজের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্তি বাতিলে ভূমিকা রাখেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের একজন সদস্য। মূলত সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই তিনি এমন কাজ করেছেন বলেও মন্তব্য করেছেন তৎকালীন শিক্ষা উপদেষ্টা। ইতোমধ্যে ৭ কলেজের দেড় লক্ষাধিক শিক্ষার্থী অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে। 


মন্তব্য