রাজ্যে রাজ্যে ধরাশায়ী ট্রাম্প, সিনসিনাটিতেও ইতিহাসের নতুন অধ্যায়

ট্রাম্প
  © ফাইল ছবি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায় একের পর এক ইতিহাসের নতুন নতুন অধ্যায় রচিত হচ্ছে। সম্প্রতি নিউইয়র্কের সাথে দেশটির আরো একটি অঙ্গরাজ্যের মেয়র পদে ট্রাম্পের সমর্থনের ভরাডুবি হয়েছে। দেশটির ওহাইও অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত শহর সিনসিনাটি মেয়র নির্বাচনেও এক ডেমোক্রেট প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। গত মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর, ২০২৫) অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজনীতিক আফতাব পুরেভাল, যিনি ইতিমধ্যেই ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেছেন। তাঁর এই বিজয় শুধু রাজনৈতিক অর্জন নয়। এটি এমন একটি সাংস্কৃতিক সঙ্কেত, যেখানে অভিবাসী প্রজন্ম দক্ষতা ও নেতৃত্ব দিয়ে আমেরিকার নগর রাজনীতিতে নতুন দিগন্ত খুলেছে।

মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আফতাব পুরেভালের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন রিপাবলিকান প্রার্থী কোরি বোম্যান, যিনি মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের ভাই। কোরি একজন খ্রিষ্টান যাজক ও কফিশপ মালিক। তাঁর প্রার্থিতা প্রথমদিকে স্থানীয় রিপাবলিকানদের মধ্যে আলোড়ন তোলে, বিশেষ করে যখন জেডি ভ্যান্স সামাজিক মাধ্যমে ভাইয়ের জন্য ভোট চেয়ে পোস্ট দেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত শহর সিনসিনাটি। ওহাইও নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই শহর একদিকে শিল্প ও বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র, অন্যদিকে শিল্পকলা, ক্রীড়া এবং উচ্চশিক্ষার জন্য বিখ্যাত। ১৮১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই নগর একসময় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহরগুলোর অন্যতম ছিল। এখানে গড়ে উঠেছে প্রসিদ্ধ ‘ইউনিভার্সিটি অব সিনসিনাটি’, আর্ট মিউজিয়াম, ঐতিহাসিক রেডস বেসবল টিম এবং বিশ্বখ্যাত সিনসিনাটি সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা। শহরটি যেমন ঐতিহ্যবাহী, তেমনি আধুনিক প্রযুক্তি ও নাগরিক সংস্কৃতির সেতুবন্ধনও এর বিশেষত্ব। 

ওহাইও রাজ্যের বিভিন্ন শহরের মতো সিনসিনাটিতেও রয়েছে একটি শক্তিশালী দক্ষিণ এশীয় কমিউনিটি (জনসংখ্যা প্রায় ৪০ হাজারের বেশি)। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা এসব দেশের মানুষ একসঙ্গে গড়ে তুলেছেন এক রঙিন সামাজিক পরিমণ্ডল। তাঁরা স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, আইটি, ফাইন্যান্স, আইন এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে শহরের অর্থনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। বিশেষ করে ইউনিভার্সিটি অব সিনসিনাটি ও বীভারক্রিক এলাকায় বাংলাদেশি ও ভারতীয় পরিবারগুলোর উপস্থিতি এখন দৃশ্যমান। 

এই কমিউনিটির মধ্যে আফতাব পুরেভাল এক অনুপ্রেরণার নাম। তাঁর নেতৃত্ব, বিনয়, এবং জনসেবার প্রতি দায়বদ্ধতা অনেক তরুণকে রাজনীতিতে আগ্রহী করে তুলেছে।

মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আফতাব ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পান এবং নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে প্রায় একই ব্যবধানে বিজয়ী হন। তাঁর জনপ্রিয়তা শুধু দক্ষিণ এশীয় বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমিত নয়; শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিন ভোটাররাও তাঁর প্রশাসনের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছেন।

এই নির্বাচনের রাজনৈতিক প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অঙ্গনে আলোচিত হয়েছে বিশেষভাবে। কোরি বোম্যানের পরাজয়কে অনেক বিশ্লেষক ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রিপাবলিকান শিবিরের আরেকটি প্রতীকী পরাজয় হিসেবে দেখছেন। কারণ, ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স হচ্ছেন ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও তাঁর রাজনৈতিক উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচিত।

যখন ট্রাম্প শিবির আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে স্থানীয় পর্যায়ে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে চাইছিল, ঠিক তখনই সিনসিনাটির এই নির্বাচনে আফতাব পুরেভালের বিজয় এক ভিন্ন বার্তা দিয়েছে। এটি দেখিয়েছে যে, আমেরিকায় মানুষ এখন বৈচিত্র্য, ন্যায়বিচার ও প্রগতিশীল মূল্যবোধকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

ওহাইও রাজ্য ঐতিহ্যগতভাবে রিপাবলিকানদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হলেও সিনসিনাটিতে আফতাবের ধারাবাহিক সাফল্য প্রমাণ করে, নাগরিক নেতৃত্বে যোগ্যতা ও সততা দলীয় বিভাজনের ঊর্ধ্বে স্থান পায়।

আফতাব পুরেভালের জন্ম ১৯৮২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, ওহাইও রাজ্যে। তাঁর পিতা দেবিন্দর সিং পুরেভাল পাঞ্জাবি বংশোদ্ভূত এবং মাতা দ্রেনকো তিব্বতীয় শরণার্থী। চার বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে বীভারক্রিকে স্থায়ী হন তিনি। তাঁর নাম ‘আফতাব’। এটি একটি প্রাচীন ফারসি শব্দ, যার অর্থ সূর্যালোক। বাবা-মা নামটির মধ্যে রেখেছিলেন নতুন জীবনের আশার প্রতীক।

রাজনীতিতে আগ্রহের সূচনা তাঁর ছাত্রজীবনেই। অষ্টম শ্রেণিতে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হন “Big, Brown and Beautiful” স্লোগান নিয়ে। এরপর ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ইউনিভার্সিটি অব সিনসিনাটি থেকে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

২০০৮ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি আইন সংস্থায় কাজের মধ্য দিয়ে শুরু তাঁর পেশাগত জীবন। পরে তিনি মার্কিন বিচার বিভাগে বিশেষ সহকারী অ্যাটর্নি হিসেবে কাজ করেন এবং ২০১৩ সালে যুক্ত হন P&G কোম্পানিতে, যেখানে তিনি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড “Olay”-এর আইনি পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 

২০১৬ সালে তিনি কর্পোরেট জগৎ ছেড়ে জনসেবায় যুক্ত হন। ২০১৫ সালে হ্যামিলটন কাউন্টির ক্লার্ক অব কোর্টস পদে নির্বাচিত হয়ে প্রশাসনিক সংস্কার আনেন। কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি করেন, পারিবারিক ছুটি চালু করেন এবং কর্মী ইউনিয়ন গঠনের অধিকার নিশ্চিত করেন।

২০২১ সালে মেয়র নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী ডেভিড এস. ম্যানকে পরাজিত করে সিনসিনাটির ইতিহাসে প্রথম এশীয়-আমেরিকান মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন।

আফতাব পুরেভালের জীবনদর্শন তাঁর পরিবার থেকে উৎসারিত। তাঁর স্ত্রী হুইটনি হুইটিস একজন চিকিৎসক; তাঁদের দুই সন্তান—বোধি ও রামি। রাজনৈতিক বক্তৃতায় পুরেভাল প্রায়ই বলেন, “আমার বাবা-মা তিব্বত ও ভারত ছেড়ে আমেরিকায় এসেছিলেন আশার সন্ধানে। আজ আমি সেই আশার প্রতীক হয়ে কাজ করতে চাই।”

তিনি এমন এক নেতৃত্বের প্রতীক, যিনি শুধু শহরের অবকাঠামো নয়, সমাজের ভেতরকার মানবিক সম্পর্ককেও গুরুত্ব দেন। তাঁর প্রশাসনে শহরের পরিবেশবান্ধব নীতি, জননিরাপত্তা, সাশ্রয়ী আবাসন এবং নাগরিক অংশগ্রহণের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। তাঁর মেয়রত্বে সিনসিনাটি ‘Green City Action Plan 2030’ বাস্তবায়ন শুরু করেছে, যার লক্ষ্য শহরের কার্বন নিঃসরণ ৫০ শতাংশ হ্রাস।

সিনসিনাটির স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্রগুলোতে আফতাবের  বিজয়কে “A victory of inclusion” এবং “A testament to the city’s changing identity” হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। অনেক সাংবাদিক মন্তব্য করেছেন, আফতাব পুরেভালের পুনর্নির্বাচন শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির জয় নয়, বরং এটি অভিবাসীদের জন্য এক আশার প্রতীক, যেখানে প্রজন্মান্তরের আমেরিকান স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমের এই প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট করেছে। সিনসিনাটি শুধু একটি শহরের গল্প নয়, এটি আধুনিক আমেরিকার পরিবর্তিত রাজনৈতিক চেতনার প্রতীক।

নিজের জীবনের অনেক মুহূর্ত মানুষ ভুলে যেতে চায়, কিন্তু কিছু স্মৃতি থেকে যায় সময়ের গায়ে লেখা হয়ে। মেয়র আফতাবও এমন এক স্মৃতি নিয়ে লিখেছিলেন ফেসবুকে, তাঁর পিতার মৃত্যুবার্ষিকীতে। সেখানে ফুটে উঠেছে এক অভিবাসী বালকের শৈশবের বেদনা, এক পিতার নীরব লজ্জা, আর আমেরিকান স্বপ্নের ভেতর গুঁজে থাকা এক টুকরো বাস্তবতা।

তিনি লিখেছেন: “আমি তখন মাত্র দশ বছর বয়সী, ফ্লোরিডার ডিজনি ওয়ার্ল্ডে গিয়েছিলাম পরিবার নিয়ে। হঠাৎ বিকেলের দিকে শুরু হলো প্রচণ্ড বৃষ্টি। বাবা আমাদের নিয়ে দৌড়ে ঢুকলেন এক রেস্তোরাঁয়। খালি একটা টেবিল দেখে আমরা বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর এক লোক এগিয়ে এসে রাগে ফেটে পড়ে বলল, ‘এই টেবিলটা আমার, উঠে যান।’ বাবা সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা চাইলেন, আমরা সবাই উঠে দাঁড়ালাম। আর ঠিক তখনই সে ঘৃণাভরা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তোমরা সবাই তোমাদের নিজের দেশে ফিরে যাও।’

ছোট্ট আমি প্রথমে বুঝতেই পারিনি কথাটার মানে কী। কারণ আমার কাছে ‘নিজের দেশ’ মানেই তো ওহাইও, যে মাটিতে আমি জন্মেছি, বড় হয়েছি। কিন্তু যখন বাবার মুখের দিকে তাকালাম, দেখলাম তাঁর চোখে এক অচেনা কষ্ট, এক অসহায় লজ্জা। সেই প্রথমবার আমি দেখেছিলাম বাবাকে সত্যিকারের অপমানিত হতে। সেই মুহূর্তে বুঝেছিলাম, একটা বাক্যও কখনও একজন মানুষকে ভিতর থেকে ভেঙে দিতে পারে।”

আফতাব পুরেভালের সেই পোস্ট কেবল তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ নয়, বরং এক প্রজন্মের অনুভূতির প্রতিধ্বনি। বৃষ্টিভেজা বিকেলের সেই দৃশ্য আজও যেন তাঁর মনে গেঁথে আছে। তবু সময়ের নদী বয়ে গেছে অনেক দূর। আর সেই অভিবাসী বালক এখন এক শহরের মেয়র। প্রমাণ করেছেন, যে মাটি তাকে ‘নিজের দেশ’ হিসেবে মেনে নিতে চায়নি, আজ সেই মাটিই তাঁর নেতৃত্বে গর্বিত।


মন্তব্য