কী ছিল এনবিআরের বহিস্কৃত কর্মকর্তার সেই দলিলে?
- বিশেষ প্রতিনিধি:
- প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৫, ১০:১৩ PM , আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২৫, ১২:২১ AM

রাষ্ট্রের গোপন দলিল প্রকাশ করার অভিযোগ এনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দ্বিতীয় সচিব (উপ-কমিশনার) মুকিতুল হাসানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
বুধবার (১৬ জুলাই) এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি)। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে এতে সই করেছেন আইআরডি সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, যেহেতু মুকিতুল হাসান রাষ্ট্রের অত্যন্ত গোপন দলিল প্রকাশ করে চাকরির শৃঙ্খলা পরিপন্থী আচরণ করায় তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে বিভাগীয় কার্যধারা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেহেতু সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ৩৯(১) ধারা অনুযায়ী তাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করে সরকারি চাকরি হতে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে আসলে কী ছিল সেই দলিলে, যা ফাঁস করেছেন বলে মুকিতুল হাসান বহিস্কার হয়েছেন?
বাংলাকন্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত মার্কিন নীতির কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে হয়তো রাজি হননি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উপ কমিশনার মুকিতুল হাসান। সেজন্য দেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) দপ্তরের দেওয়া একটি গোপন চিঠি প্রকাশ করেছেন বলে অভিযোগ এনে সরকার তাঁকে বরখাস্ত করেছে। কাকতালীয়ভাবে বিষয়টির সত্যতাও মেলে একদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সফর করে দেশে ফেরা বাণিজ্য উপদেষ্টা বশির উদ্দিনের কথায়ও। দেশে ফিরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে কি চুক্তি হয়েছে সেটি প্রকাশ করা যাবে না। উপদেষ্টার এমন বক্তব্যে সঙ্গতই প্রশ্ন জেগেছে তাহলে কি ছিল সেই মার্কিন শুল্ক চুক্তির আড়ালে?
জানা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের উপর নতুন করে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। যা নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শুরু হয়ে গিয়েছে নতুন করে বিতর্ক।
এই বিতর্ক আরও বেড়েছে যখন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন বলেছেন, ১০ এবং ১১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে, সেটা ইতিবাচক। আগামী সপ্তাহে বাণিজ্য উপদেষ্টাসহ প্রতিনিধি দল আবারও যুক্তরাষ্ট্র যাবেন শুল্ক আরোপের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে।
প্রশ্ন উঠছে, যখন আলোচনা সফলই হল, তাহলে কেন অতিরিক্ত ৩৫ শতাংশ শুল্ক চাপালেন ডোনাল্ড ট্রাম্প? আবার কেনই বা দ্বিতীয় দফার আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হবে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে? কিন্তু যে বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক শুরু হয়েছে, সেটা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা শেষে এ বিষয়ে যে চুক্তি হবে, তা কোনোভাবেই প্রকাশ করা যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন। সোমবার সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
মূলত বাংলাদেশি পণ্যে মার্কিন শুল্ক আরোপের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হওয়া অন্যান্য পণ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের বৃহৎ রফতানি পণ্য রেডিমেড পোশাক শিল্পে এর প্রভাব কতটা পড়বে তা নিয়েই চলছে মূল বিশ্লেষণ। প্রসঙ্গত, আগে থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। এখন ৩৫ শতাংশ শুল্কারোপ করা হবে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে জানানো হয়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষিতে আলোচকদের ‘যোগ্যতা’ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন দেশের বিশেষজ্ঞরা। বিশেষত ডোনাল্ড ট্রাম্পের চিঠি এসে যাওয়ার পর বাংলাদেশের পণ্যে শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার লোক মার্কিন মূলুকেই কেউ নেই বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে কেউ কেউ দাবি করছেন, যেহেতু এখনও মিয়ানমারে রাখাইন করিডোর নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চলছে, সেহেতু ডঃ খলিলুর রহমান বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে মার্কিন মুলুককে খুব একটা চাপ দিতে অপারগ। কারণ, এখনও তলে তলে রাখাইন মানবিক করিডোরের কাজ চলছে বাংলাদেশে। সেই কারণেই বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা শেষে এ বিষয়ে যে চুক্তি হবে, তা কোনোভাবেই প্রকাশ করা যাবে না। অর্থাৎ, ভিতরে ভিতরে অন্য কিছু হচ্ছে। সে কারণেই বাংলাদেশের বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের থেকে শুরু করে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
শুল্ক কমানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের শর্তগুলো মেনে চুক্তি করলে বাংলাদেশের উপর কেমন প্রভাব পড়তে পারে তা বোঝার জন্য উদাহরণ স্বরূপ অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত ধারাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়-
ধারা ১ অনুসারে বাংলাদেশকে জাহাজ নির্মাণ ও চলাচল বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি অনুসরণ করতে হবে যার উদ্দেশ্য হলো বাজার অর্থনীতির দেশগুলোর জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজের মাধ্যমে পরিবহনকে উৎসাহ দেওয়া। বাজার অর্থনীতির দেশকে উৎসাহিত করবার অর্থ হলো চীনের মতো কমিউনিষ্ট দেশের জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজ পরিবহনকে নিরুৎসাহিত করা। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এ ধরণের চুক্তি করলে চীনের সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়া অবশ্যম্ভাবী।
ধারা ২ অনুসারে, বাংলাদেশকে তার বন্দর, টার্মিনাল, পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা ও বাণিজ্যিক জাহাজে চীনা ডিজিটাল লজিস্টিকস প্ল্যাটফর্ম, বিশেষ করে 'লজিংক' ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে বাংলাদেশ চীনা প্রযুক্তি নিষিদ্ধ করলে একদিকে প্রযুক্তি ব্যবহারে ফ্লেক্সিবিলিটি কমে যাবে, অন্যদিকে চীনের সাথে সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হবে যা বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী হবে।
ধারা ৩ অনুসারে, বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা মেনে চলতে হবে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের আওতায় থাকা পণ্য তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানোর আগে যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি নিতে হবে। এর ফলে বাংলাদেশের রপ্তানিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বাড়বে এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ফ্লেক্সিবিলিটি হ্রাস করবে।
ধারা ৪ অনুসারে, বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ নীতিমালার আওতায় থাকা পণ্যের লেনদেন স্ক্রীনিং করতে হবে এবং এসব তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শেয়ার করতে হবে। এর ফলে বাংলাদেশ সরকারকে কাস্টমসের স্পর্শকাতর তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সরবরাহ করতে হবে। চীন বা তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে হওয়া লেনদেনকে যুক্তরাষ্ট্র ‘উদ্বেগজনক’ মনে করলেই হস্তক্ষেপ করতে পারবে।
ধারা ৫ অনুসারে, বাংলাদেশকে নিজস্ব রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যেখানে দেওয়ানি ও ফৌজদারি শাস্তির বিধান থাকবে। রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ বিধিমালার লংঘিত হলে যুক্তরাষ্ট্রকে সে বিষয়ে জানাতে হবে এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এরফলে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা মেনে এমন সব শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হতে পারে, যা তার নিজস্ব ব্যবসা-বান্ধব নীতি বা আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে।
ধারা ৬ অনুসারে, বাংলাদেশকে এমন সফটওয়্যার বা প্রযুক্তি সাপ্লাই চেইন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে হবে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ রয়েছে (যেমন চীন)। এর ফলে বাংলাদেশকে নিজস্ব সুবিধা ও বিবেচনা বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তাকে মাথায় রেখে প্রযুক্তি বাছাই করতে হবে।
কাজেই দেখা যাচ্ছে এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অর্থনীতি, আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য ও প্রযুক্তি খাতের ওপর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। সেই সাথে চাচ্ছে চীন ও অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সীমিত করতে। এর ফলে বাংলাদেশের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা, বাণিজ্যিক স্বাধীনতা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে বড় ধরনের বাধা তৈরী হবে। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ৮৬৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৮ শতাংশের কিছু বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ৮৫ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক।
বলা হচ্ছে, এমন একটি র্স্পশকাতর বিষয় হয়তো দেশ প্রেমিক কোনো সরকারী কর্মকর্তার মেনে নিতে কষ্ট হবে। কিন্তু ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে করা চুক্তির এ গুরুত্বপূর্ন দলিলটি ফাঁস হয়ে গেছে। এতেই কপাল পুড়েছে মুকিতুল হাসানের। তাই রাষ্ট্রের গোপন দলিল প্রকাশের অভিযোগে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। কারণ, সরকারী চাকুরী বিধিতে বলা আছে, ‘সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো কর্মচারী গোপন নথি প্রকাশ করতে পারেন না। যদি তার কিছু বলার থাকে, যদি মনে হয়, যা হচ্ছে, সেটি সঠিক নয়, তাহলে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে মতামত জানাতে পারেন। তিনি সাধারণ নাগরিক নন। সাধারণ নাগরিক ও সরকারি চাকরিজীবীর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সরকারি নিয়মকানুন মানতে হবে। বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।’
প্রসঙ্গত, ১ অগাস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ ‘পাল্টা’ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই বার্তা দিয়ে তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন তিনি। যদিও এই চিঠি নিয়ে বাংলাদেশের তরফে খুব একটা উচ্চবাচ্য করা হয়নি এখনও।