পূজায় মতবিনিময় কিংবা দাওয়াতি উদ্দেশ্যে গমন কতটা জায়েজ?

ধর্মীয়
  © সংগৃহীত

রাসূলুল্লাহ্‌ (সা.)-এর সাহাবীগণ অমুসলিমদের ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রবেশ করেছেন এবং সেখানকার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন—এমন একাধিক নির্ভরযোগ্য দলিল রয়েছে। যেমন, আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) ও মু’আবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.) গির্জায় প্রবেশ করেছেন এবং সেখানে আহারও করেছেন। (ইবন কুদামাহ, আল-মুগনী, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৪০৫ হি., খণ্ড ৮, পৃ. ১১৩)। এমনকি কিছু সাহাবী সেখানে নামাজও আদায় করেছেন। (ইবন হাজার আল-আসকালানী, ফাতহুল বারী, দারুল ফিকর, বৈরুত, খণ্ড ১, পৃ. ৫৩১)।

এক নির্ভরযোগ্য বর্ণনায় এসেছে—যখন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) শামে আগমন করেন, তখন খ্রিষ্টানরা তাঁর জন্য ভোজের আয়োজন করে তাঁকে ডাকলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন: “কোথায়?” তারা উত্তর দিল: “গির্জায়।” উমর (রা.) সেখানে প্রবেশ করতে অস্বীকার করলেন এবং আলী (রা.)-কে নির্দেশ দিলেন: “তুমি লোকদের নিয়ে সেখানে গিয়ে আহার করো।” তখন আলী (রা.) লোকদের নিয়ে গির্জায় প্রবেশ করে খাওয়া-দাওয়া করলেন। এরপর তিনি ভাস্কর্যগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন: “আমীরুল মু’মিনীন (উমর ইবনুল খাত্তাব) যদি এখানে প্রবেশ করতেন, তাতে কী ক্ষতি হতো?” (আল-মুগনী, খণ্ড ৮, পৃ. ১১৩, আল-মাকতাবাহ আশ-শামিলাহ ৩.১৩)।

ইতিহাসে আরও পাওয়া যায় যে, উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) কখনও কখনও আহলে যিম্মার গির্জা ও মঠ সম্প্রসারণে অনুমতি প্রদান করেছিলেন, এই শর্তে যে প্রয়োজনে মুসলমানরা সেখানকার স্থাপনা ব্যবহার করতে ও রাতযাপন করতে পারবে। (ইবন কুদামাহ, আল-মুগনী, খণ্ড ৮, পৃ. ১১৩)।

হাম্বলি আলিম ইবন কুদামাহ তাঁর আল-মুগনী গ্রন্থে এ বিষয়ে আলেমদের বিভিন্ন মতামত আলোচনা করেছেন এবং উপসংহারে বলেছেন—গির্জায় প্রবেশ করা জায়েয, যদিও সেখানে মূর্তি থাকে; কেননা, এর প্রমাণ সাহাবীগণের বাস্তব আমলেই বিদ্যমান। (আল-মুগনী, খণ্ড ৮, পৃ. ১১৩)।

কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে দাওয়াতের প্রয়োজনীয়তা

উপরোক্ত দলিলসমূহ থেকে স্পষ্ট হয় যে, কোনো কল্যাণকর বা দাওয়াতি উদ্দেশ্যে অমুসলিমদের ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রবেশ করা শরীয়তসম্মত। কোরআনেও এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা রয়েছে—

সুরা মুমতাহিনা (আয়াত ৮): শান্তিপ্রিয় অমুসলিমদের সাথে সদাচরণ, মানবিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতা করা প্রশংসনীয়।

সুরা নাহল (আয়াত ১২৫): “তুমি তোমার প্রভুর পথে দাওয়াত দাও প্রজ্ঞার সাথে, উত্তম উপদেশ দ্বারা।”—এ নির্দেশ মূলত অমুসলিমদের প্রতিই। ফলে দাওয়াত দিতে হলে তাদের বাড়ি, সভা-সমাবেশ ও উপাসনালয়ে যাওয়া প্রয়োজন হতে পারে।

সুরা কাহাফ (আয়াত ৮): “হয়তো তুমি তাদের ঈমান না আনার কারণে দুঃখে নিজেকে ধ্বংস করে ফেলবে।” এই আয়াত প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ্‌ (সা.) অমুসলিমদের জন্য কতটা হৃদয়স্পর্শী মমতা ও হেদায়েতের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতেন। তিনি যদি তাঁদেরকে কেবল শত্রু ভাবতেন, তবে এ রকম আবেগ তাঁর হৃদয়ে জন্মাত না।

অতএব, কোরআন ও হাদিসের এই দলিলসমূহ প্রমাণ করে যে অমুসলিমদের কাছাকাছি গিয়ে, তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলাপ করে, দাওয়াতের পরিবেশ সৃষ্টি করা সুন্নাহসম্মত ও শরীয়তসমর্থিত কাজ।

কিছু নিষেধাজ্ঞামূলক দলিল

তবে অন্যদিকে, কিছু হাদিস রয়েছে যেখানে মুশরিকদের বিশেষ অনুষ্ঠানকালে তাদের উপাসনালয়ে প্রবেশ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। যেমন—

ইমাম বাইহাকি (রহ.) সহিহ সনদে উমর (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন:
“মুশরিকদের উৎসবের দিনে তাদের উপাসনালয়ে প্রবেশ করো না, কেননা ওই সময় তাদের ওপর আল্লাহর গজব নাযিল হয়।” (আহকামুযযিম্মাহ ১/৭২৩)।

ইবনু আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত:
রাসূলুল্লাহ্‌ ﷺ কা‘বার ভেতরে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানান, যতক্ষণ না সেখানকার ছবি ও প্রতিমা অপসারণ করা হয়। (বুখারী, হাদিস ৩৩৫২)।

এই হাদিসগুলো মূলত উপাসনালয়ের ভেতরে প্রবেশকে নিষিদ্ধ করেছে, বিশেষত যখন সেখানে শিরকীয় অনুষ্ঠান বা প্রতিমাপূজা চলছে।

সমকালীন প্রেক্ষাপট

আমাদের দেশে পূজার সমাবেশগুলো সাধারণত মন্দিরের বাইরে খোলা মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়। এমতাবস্থায়, এমপি প্রার্থীরা বা অন্য মুসলিম ব্যক্তিরা যদি সেখানে উপস্থিত হয়ে মতবিনিময় করেন, তবে তা উপরোক্ত হাদিসের নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত নয়। কেননা তারা মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করছেন না।

পরিশেষে পক্ষে-বিপক্ষে সব দলিল বিশ্লেষণ করে এবং সমসাময়িক বিশ্ব ফিকহ কাউন্সিলসমূহের জমহুর ফতোয়ার আলোকে বলা যায়—
দাওয়াতি উদ্দেশ্যে পূজার সমাবেশে উপস্থিত হওয়া ও মতবিনিময় করা জায়েয। তবে সেখানে গিয়ে শিরকীয় কাজ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা জরুরি এবং দাওয়াতি কাজ সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করা উচিত।

লেখক: সরকারী চাকুরীজীবি ও প্রাক্তন ছাত্র, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।


মন্তব্য